১৯৫২ থেকে ২০২২। সত্তর বছর আগে বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের লক্ষ্যে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। বিশ্বে এমন ইতিহাস বিরল যে জাতিকে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়, বাংলাজুড়ে আছে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রাম।

ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পূর্তির লগ্নে এসে বাংলা ভাষাকে নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠনের নেতাদের ভাবনা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিগুলো তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

মায়ের ভাষা বাংলা পূর্ণ মর্যাদা পাক

বাঙালি জাতিসত্তার এক অনন্য পরিচায়ক বাংলা ভাষা। দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছি, দিনে দিনে পেরিয়েছে ৭০ বছর। ভাষার জন্য আত্মদান পৃথিবীর কাল পরিক্রমায় বিরল এক দৃষ্টান্ত, বিস্ময়ের সাথে তাবত দুনিয়াবাসী জ্ঞাত; বাঙালির সাহস-আত্মত্যাগের গাঁথায়। আমরা গর্বিত, কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থান উপলব্ধি করলে দেখা যায় ‘বাংলা ভাষা’ নিয়ে জাতিগতভাবে আমাদের যে আত্মত্যাগ, সেই অনুযায়ী তার ফলাফল খুব-একটা যুৎসই হয়নি।

শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে দাপ্তরিক পর্যায়ে বাংলাভাষার প্রাধান্য যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বড় আক্ষেপের বিষয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বা ৫২-র আজ ৭০ বছর অতিক্রম করলেও সময়ের তুলনায় বাংলা ভাষায় সেই অর্থে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রসার নেই বললেই চলে।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলবিদ্যার মতো বিষয়গুলো পড়ানো হয়। গবেষণার ক্ষেত্রে তো বাংলা ভাষা একরকম অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ, এমন দশা। ‘বাংলা ভাষা’র পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার চর্চা ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তা করা গেলেই মূলত আত্মত্যাগী বীরদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন পূর্ণতা পাবে। ছোট্ট স্বপ্ন পরিবারও এমনি আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে।

অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক বাংলা ভাষা

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের শুরু থেকে সৃষ্টি হতে থাকে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চিরপ্রেরণা ও অবিস্মরণীয় একটি দিন। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, এখন এটি সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। জাতির জীবনে শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর এই দিনটি।

একুশ এখন সারা বিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার ‘শহীদ মিনার’। কিছু ঘটনা চেতনার আলো ছড়ায় সারা বিশ্বে। সে চেতনার দৃপ্ত শপথজুড়ে আছে আমাদের ভাইয়েরা, আমাদের ভাষা শহীদরা। সঙ্গে আছে সেই ঢাকা মেডিক্যাল প্রাঙ্গণ, সেই রক্তের ইতিহাস। মাতৃভাষার সুরক্ষা, বিকাশ এবং অনুশীলন ছাড়া কোনো জাতি অগ্রসর হতে পারে না, বাঙালি জাতি তো নয়ই। আর এভাবেই বাংলা ভাষা দিনে দিনে হয়ে উঠছে বিশ্বায়নের অন্যতম মাধ্যম।

পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক বাংলা ভাষা

একটা জাতি তার মাতৃভাষা দিয়ে নিজেকে তুলে ধরে। ভাষা তার নিজস্ব স্বকীয়তা বহন করে। আমি চাই আমাদের এই প্রাণের ভাষা বাংলা ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, সর্বত্র। বর্তমানে বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে কলুষিত করা হচ্ছে। রক্ত দিয়ে অর্জন করা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। যতটা অর্জন দিয়ে কেনা এ ভাষা, বর্তমানে তার চেয়ে বেশি অবহেলিত এ ভাষা।

১৯৫টি দেশের ৭০০ কোটিরও বেশি মানুষ ৬ হাজার ৯০৯টি ভাষায় কথা বলে। তাদের এত ভাষার মধ্যে শুধু বাংলা ভাষার সম্মানার্থে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই বর্তমান তরুণ ছাত্রসমাজের উচিত বাংলা ভাষার সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও পৃথিবীর সর্বত্র বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা। সর্বোপরি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা উচিৎ।

মাতৃভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগই হোক অঙ্গীকার

একুশে ফেব্রুয়ারি মানে হচ্ছে জ্বলন্ত শিখা। যা আমাদের স্বাধীনভাবে মনের ভাব প্রকাশে অবদান রাখছে। আজকের বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে বাংলার অবদান, যার জন্য আমাদের বীরেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি, যা বিশ্বের আর কোনো জাতি করেনি। বাংলা ভাষায় কথা বলার মধ্যে অদ্ভুত ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়৷আমাদের বাংলার রয়েছে হরেকরকম আঞ্চলিকতা। যা আমাদের ভাষাকে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত করেছে। তবে দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা থেকে আমরা অনেকটা পিছিয়ে।

শুদ্ধভাবে বাংলা পড়তে এবং শিখতে আমাদের অনীহা। বাংলা ভাষা চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা এবং বিকাশ নিয়ে কোর্স চালু করা উচিত। যেমন করে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ ছিল, ঠিক তেমনি বাংলা ভাষা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। যাদের অবদানে আজ আমরা গর্বের সঙ্গে কথা বলতে পারছি এবং বিশ্বের ময়দানে বাংলাকে তুলে ধরতে পারছি, তাদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

সর্বস্তরে মাতৃভাষার চেতনা বাস্তবায়িত হোক

ভাষার মাস এলে ভাষার গান, ভাষার আলোচনা, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থেকে পুরো বছর বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক চেতনার জাগরণ ও চর্চা থেকে বিমুখ থাকি। অপরিচিত ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ফলে নিজস্ব চিন্তা ও মেধাশক্তিকে যথার্থভাবে বিকশিত করতে পারিনি বলে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান ভয়ানক সমস্যায় জাতি আজ জর্জরিত।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা ও গবেষণার ফলে। তাই বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অবহেলার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়গুলো বাংলাতেই করা এখন সময়ের দাবি। তাহলে বাঙালি হিসেবে নিজস্ব ঐতিহ্যকে জাগ্রত করার পাশাপাশি নিজেদের চিন্তা ও মেধাশক্তিকে ফলপ্রসূ করা আমাদের জন্য সহজ হবে। বাস্তবায়িত হবে লাখো শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা।

উচ্চশিক্ষায় বাংলার প্রচলন শুরু হোক

বেশ কয়েকবছর যাবত উচ্চশিক্ষায় বাংলার প্রচলন করার কথাবার্তা চলছে৷ কিন্তু এটা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা গেলো না। চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো বিশ্বের নানা দেশ উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য হারে সফলতা অর্জন করছে। ইউজিসির (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট (ইআইইউ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে বাংলাদেশের শতকরা ৪৭ ভাগ স্নাতকই বেকার। এর কারণ হিসেবে বলা যেতেই পারে স্নাতকদের কিছুটা হলেও দক্ষতার অভাব রয়েছে।

উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গবেষণাসহ অনেকগুলো বিষয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি হুট করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। আশা রাখি, শিক্ষাক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা এটা নিয়ে অগ্রসর হবেন।

বাংলা ভাষা ব্যবহার ও চর্চায় সচেতনতা জরুরি

মাতৃভাষা হলো মানব অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান একটি অবলম্বন। যে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি প্রাণ দিয়েছিল, সেই ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে তরুণ সমাজের যথাযথ সচেতনতা নেই। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ও চর্চা বেশি। তরুণরা আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন, চাকরি, অফিস-আদালতসহ প্রতিক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না, নিজস্বতা হারাচ্ছে বাংলা ভাষা।

এ ছাড়া, উচ্চশিক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই, যা ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি, ভাষাকেন্দ্রিক সচেতনতা, আবেগ কিংবা নিজস্ব সংস্কৃতিবোধের জায়গাটি নিশ্চিত করতে পূর্বসূরীদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। হোক প্রতিজ্ঞা- যে মুখে মা বলবো, সে মুখেই মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষা করবো। তরুণ সমাজ সচেতন হলেই বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা বৃদ্ধি পাবে, এই ভাষাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। তাই এই মাতৃভাষাকে ও একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে তরুণ সমাজকে।

ভাষা হোক উন্মুক্ত, হোক প্রতিবাদের ধ্বনি

ভাষার প্রতি কতটা আবেগ ও ভালোবাসা থাকলে নিজের শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে আনতে পারে তার প্রমাণ বায়ান্নর ভাষা শহীদরা। আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সব ভাষা একত্রে বলছে ও লিখে কোনো ভাষাতেই সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না।

বাংলা ভাষার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবার প্রতি সচেতনতা তৈরির বিকল্প কিছু হতে পারে না। একুশের চেতনায়, ভাষা আন্দোলনের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। আমরা মাতৃভাষা ছিনিয়ে আনতে পারলেও এখনো সম্পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারিনি। ভাষার মাসে একটাই প্রত্যাশা, মাতৃভাষাকে যথার্থ সম্মান দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।

 

কলমকথা/সাথী